এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে রাজনীতি আছে

জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ

সাক্ষাৎকার

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর গতকাল তাঁর নিজ বাসভবনে আজকের পত্রিকার সঙ্গে কথা বলেন আজিজ আহমেদ। ছবি: আজকের পত্রিকা

ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে যে অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা সত্য নয় বলে দাবি করেছেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। তিনি বলেছেন, নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি যদিও ব্যক্তিগত, তারপরও বর্তমান সরকারের সময়ে তিনি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই ঘটনাটি কিছুটা হলেও সরকারকে হেয় করে। তাঁর ভাষায়, ‘এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে রাজনীতি আছে।’

ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় সোমবার (বাংলাদেশ সময় সোমবার মধ্যরাতের পর) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতিতে আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞার কথা জানানো হয়। এ নিষেধাজ্ঞার ফলে তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন না।

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও তার পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে গতকাল মিরপুর ডিওএইচএসের বাসভবনে আজকের পত্রিকার সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আজকের পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কামরুল হাসান। পুরো কথোপকথন নিচে তুলে ধরা হলো:

প্রশ্ন: আপনার ও আপনার পরিবারের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেটাকে কীভাবে দেখছেন?

উত্তর: এটা শুনে আমি অবাক ও মর্মাহত হয়েছি। বিষয়টি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমার বিরুদ্ধে যে দুটো অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সত্য নয়, মিথ্যা।

প্রশ্ন: আপনার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, আপনি আপনার ভাইকে

অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি এড়াতে সহযোগিতা করেন। এটা করতে

গিয়ে আপনি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন।

উত্তর: আপনারা হয়তো খেয়াল করবেন, কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান’ নামে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছিল, সেখানে সেই একই কথা ছিল। তাহলে সহজেই বুঝতে পারছেন আল জাজিরার তথ্যচিত্র ও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা একই সূত্রে গাঁথা।

প্রশ্ন: আপনার বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ হলো, সেনাপ্রধান হিসেবে আপনি নিজের ভাইকে সামরিক কাজ দিয়ে ঘুষ নিয়েছেন, দুর্নীতি করেছেন।

উত্তর: আমি চার বছর ডিজি বিজিবি থাকাকালে কিংবা তিন বছর সেনাপ্রধান থাকাকালে আমার কোনো ভাইকে বা কোনো আত্মীয়কে কোনো কন্ট্রাক্ট দিয়েছি, এমন যদি কেউ প্রমাণ করতে পারে, আমি যেকোনো পরিণতি মেনে নিতে প্রস্তুত আছি। দেখুন, একই কথা আল জাজিরাতে ছিল। তারাও বলেছে, আমি আমার দাপ্তরিক সুবিধা ব্যবহার করে ভাইকে সুবিধা দিয়েছি। তারা যে ভাইয়ের কথা বলছে, সে ভাই ২০০২ সালের পর থেকে বাংলাদেশে নেই। তাহলে কী করে অভিযোগ সত্য হলো?

প্রশ্ন: আরও অভিযোগ ছিল, আপনি আপনার সেই ভাইকে জেলখানা থেকে ছাড়িয়ে আনতে সহায়তা করেছেন।

উত্তর: তাঁকে ক্ষমা করার ব্যাপারে মহামান্য রাষ্ট্রপতি যে চিঠি দিয়েছিলেন, সেখানে উল্লেখ আছে, তাঁদের অভিযোগ ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ। কারণ, আমার ভাই আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এখানে আমি কী করে পদের অপব্যবহার করলাম?

প্রশ্ন: তাহলে আপনি আপনার ভাইকে ছাড়াতে কোনো সহযোগিতা করেননি?

উত্তর: না। আমি বলছি, সহযোগিতা করিনি। আমার ভাইয়ের সাজা মওকুফে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না।

প্রশ্ন: সেনাপ্রধান হওয়ার ছয় মাস আগে আপনার এক ভাই জেল থেকে মুক্তি পান, তখন আলোচনা ছিল যে আপনি প্রভাব খাটিয়েছেন।

উত্তর: দেখুন, অভিযোগের প্রমাণ লাগে। কোনো সংবাদমাধ্যম কি প্রমাণ দিয়ে সেটা বলতে পেরেছে? পারেনি।

প্রশ্ন: আপনি সেনাপ্রধান হওয়ার পর আপনার আরেক ভাই জেল থেকে মুক্তি পান, সেটা নিয়েও সমালোচনা ছিল।

উত্তর: দেখুন, কারামুক্তির প্রক্রিয়াটি অনেক আগে থেকে হয়। যখন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তখন আমি সেনাপ্রধানই ছিলাম না।

প্রশ্ন: শেষ পর্যন্ত এসব ঘটনাই কি নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে?

উত্তর: এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই।

প্রশ্ন: আপনার এক ভাই সন্ত্রাসী মামলায় সাজা খাটার পর সেনাপ্রধানের বাসায় থেকেছেন, এটা কি ঠিক?

উত্তর: তারা তখন সবকিছু থেকে মুক্ত। তখন তাদের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের অভিযোগ ছিল না। তাহলে আমার বাসায় আসাটা কি অন্যায়? তারা আমার নয়, নিজের বাসাতেই থেকেছে।

প্রশ্ন: আপনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। আপনি কি মনে করেন এ নিষেধাজ্ঞা সেসব প্রতিষ্ঠানকেও বিতর্কিত করেছে?

উত্তর: দেখুন, নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে কোনো প্রতিষ্ঠান জড়িত নয়। এটা ব্যক্তির বিরুদ্ধে, প্রতিষ্ঠানের নয়।

প্রশ্ন: তাহলে আপনি বলছেন, এতে কোনো প্রতিষ্ঠানের গায়ে দাগ লাগছে না?

উত্তর: আমি মনে করি, শুধু আমাকে বিতর্কিত করার জন্য এটা হয়েছে। তারপরও যারা আমাকে নিয়োগ দিয়েছে, তারাও কিছুটা হলে এর মধ্যে চলে আসে।

প্রশ্ন: সরকারের কি কোনো দায় আছে বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর: না, আমি সেটা মনে করি না। আমি এটাকে দায় হিসেবে নিতেই চাই না, এটা মিথ্যে।

প্রশ্ন: তাহলে বলুন, আপনাকে ঘিরে এত অভিযোগ কেন? আর কারও বিরুদ্ধে তো এমন অভিযোগ শোনা যায় না।

উত্তর: শুধু আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, এটা আমি মানব না। দেখুন, আমি দুটি বাহিনীর প্রধান থাকার সময় দেশে দুটি নির্বাচন হয়েছে। আর কাউকে এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি। তারপরও আমি অন্যদের নিয়ে কিছু বলতে চাই না।

প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন, এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে আপনাকে একটি নৈতিক দায়ের মুখে পড়তে হয়েছে?

উত্তর: আমি কেন নৈতিক দায় নেব? দুটি বাহিনী কমান্ড করার সময় আমি এমন কিছু করিনি যে সুনাম ক্ষুণ্ন হতে পারে। এখন কেউ আপনাকে পছন্দ না করে কিছু বললে তার দায় তো আপনার হতে পারে না।

প্রশ্ন: আপনার পরিবারের লোকজন তো রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ছিল, তাহলে এসবের পেছনে কোনো রাজনীতি থাকতে পারে বলে মনে করেন?

উত্তর: আমার পরিবার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু আমি তো সৈনিকই ছিলাম। তারপরও আমাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। একদল এসে বলেছে আমি অন্য দলের, আবার সেই দল এসে অন্য কথা বলেছে।

প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন, এ ঘটনা সরকারকে বিব্রত করেছে?

উত্তর: এটা বলে আমি বিষয়টি সরকারের ঘাড়ে নিয়ে যেতে চাই না। দায় আসবে কি না সেটা সরকার মূল্যায়ন করবে। তা ছাড়া বিষয়টি তো সত্য নয়, তাহলে দায়ের প্রশ্ন কেন?

প্রশ্ন: তাহলে এর কোনো তাৎপর্য নেই বলছেন?

উত্তর: এটা একেকজনে একেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবেন। আমার দৃষ্টি আলাদা।

প্রশ্ন: তাহলে আপনি বিষয়টিকে কোণ দৃষ্টিতে দেখছেন?

প্রশ্ন: আমার দৃষ্টি হলো, এটা আমি ও আমার পরিবারের জন্য দুর্ভাগ্যজনক।

প্রশ্ন: আপনার বা আপনার পরিবারের কোনো সম্পদ কি আমেরিকায় আছে?

উত্তর: না, কানাকড়িও নেই।

প্রশ্ন: নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি কি সরকার বা আমেরিকার পক্ষ থেকে আপনাকে জানানো হয়েছিল?

উত্তর: না, আমি জানতাম না। আজ সকালে আমার এক বন্ধু এটা জানাল।

প্রশ্ন: এখন আপনি কী করবেন ভাবছেন?

উত্তর: এতে কী করার আছে?

প্রশ্ন: নিষেধাজ্ঞার ফলে আপনি আমেরিকা ও তাদের বন্ধু দেশে যেতে পারবেন না।

উত্তর: এটা মনে হয় ঠিক না। আমি তো ঘুরে বেড়াচ্ছি, কেউ না করেনি। আমি মনে করি না নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশের বাইরে যেতে পারব না। আর আমেরিকায় যেতেই হবে, এমন কোনো কথা আছে?

প্রশ্ন: আপনার নিষেধাজ্ঞার পেছনে রাজনীতিটা কী?

উত্তর: রাজনীতি অবশ্যই আছে। আল জাজিরা কী করেছে দেখুন, তারা আমার আমেরিকা সফর বাতিল করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেটা পারেনি। ৯টা এনজিও জাতিসংঘ সদর দপ্তরে আবেদন করেছিল যাতে কেউ আমার সঙ্গে বৈঠক না করে। সেটাও পারেনি। আল জাজিরা আমাকে, দেশের সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে হেয় করতেই সেটা করেছিল।

প্রশ্ন: আর এখন?

উত্তর: হয়তো সরকারকেও কিছু হেয় করতেই এটা করা হয়েছে। তবে আমি এটা বলতে চাই না। কারণ, আমি এখন সরকারের কেউ নই।

প্রশ্ন: আপনাকে ধন্যবাদ।

উত্তর: আপনাকেও।