তথ্যভান্ডারে মার্চের চাপ

ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই

মো. হুমায়ূন কবীর, ঢাকা

জাতীয় তথ্য ভান্ডার থেকে সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্য যাচাই অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। শুধু চলতি বছরের মার্চ মাসেই এসব সংস্থা প্রায় সাড়ে চার লাখ লোকের তথ্য যাচাই করেছে। এ সংখ্যাকে ‘অত্যধিক ও অস্বাভাবিক’ বলছে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ। তারা বলছে, সংস্থাগুলোর অতিরিক্ত তথ্য যাচাইয়ের চাপ পড়ছে বায়োমেট্রিক আইডেনটিফিকেশন সার্ভারে। এতে করে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে যে হারে তথ্য যাচাই করা হচ্ছে, তা কমাতে কমিশন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারকে (এনটিএমসি) চিঠিও দিয়েছে।

জানতে চাইলে এ বিষয়ে এনটিএমসির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিভিন্ন সংস্থা এনটিএমসির মাধ্যমে নিয়ম অনুযায়ী তথ্য নিয়ে থাকে। তারা তাদের দরকার অনুযায়ী তথ্য নিয়েছে, এখানে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে মার্চ মাসে হঠাৎ করে এ সংখ্যা এত কেন বেড়ে গেল, সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি।

দেশের মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং টেলিফোনে যোগাযোগের যাবতীয় তথ্যের ভান্ডার হলো এনটিএমসি। দেশের সব আইন প্রয়োগকারী, তদন্ত ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা এনটিএমসি থেকে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী তথ্য নিয়ে থাকে। এসব তথ্য সরবরাহের জন্য ‘ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স প্ল্যাটফর্ম বা এনআইপি’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। প্রতিটি সংস্থা নিজস্ব আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে সেই প্ল্যাটফর্মে ঢুকে তথ্য নেয়। তবে কোন সংস্থা কোন তথ্য নিচ্ছে, তার ‘লগ’ থেকে যায় এনটিএমসিতে। এতে করে কোন সংস্থা কার তথ্য নিচ্ছে, তা সহজে জানতে পারে এনটিএমসি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ ৪২টি সংস্থা জাতীয় পরিচয়পত্র-সংক্রান্ত কোনো তথ্য নিতে চাইলে তা এনটিএমসির মাধ্যমেই নিয়ে থাকে। এনটিএমসি এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সার্ভারের ‘প্রবেশদ্বার’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, সংস্থাটির জাতীয় তথ্য ভান্ডার থেকে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ১৮৩টি প্রতিষ্ঠান নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য নিতে পারে। সবার তথ্য নেওয়ার হার স্বাভাবিক থাকলেও এনটিএমসির মাধ্যমে তথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয় গত মার্চ মাসে। এনটিএমসি সাধারণত গড়ে প্রতি মাসে ৪৫ হাজার মানুষের তথ্য নিয়ে থাকলেও মার্চ মাসে নিয়েছে ৪ লাখ ৪০ হাজার, যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ১০ গুণ। তথ্য নেওয়া এভাবে বেড়ে যাওয়ার ঘটনাকে অস্বাভাবিক মনে করছে নির্বাচন কমিশন। সংস্থাটি জানায়, এনটিএমসি থেকে

প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৭ হাজার তথ্য যাচাইয়ের অনুরোধ আসছে। এত অনুরোধের কারণে বায়োমেট্রিক আইডেনটিফিকেশন সেবা দেওয়ার স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি ইসি সচিবালয়সহ মাঠপর্যায়ের কার্যালয় এবং ইসি থেকে এই সেবা নেওয়া অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বায়োমেট্রিক আইডেনটিফিকেশন সেবা দেওয়ার কাজও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাইয়ের অনুরোধের সংখ্যা সীমাবদ্ধ (প্রতি সেকেন্ডে একটি অনুরোধ) রাখতে এনটিএমসির কাছে অনুরোধ করেছে নির্বাচন কমিশন। সেই সঙ্গে সব অনুরোধ একই সঙ্গে না পাঠিয়ে বিরতি দিয়ে পাঠাতে বলা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের এনআইডি ডেটাবেইস থেকে নাগরিকের তথ্য যাচাই সেবা নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো এনআইডি নম্বর ও জন্মতারিখ, মাস ও সাল দিয়ে নাগরিকের তথ্য যাচাই করে থাকে। সম্প্রতি এনটিএমসি এনআইডি ডেটাবেইস থেকে শুধু এনআইডি নম্বর দিয়ে অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেসের (এপিআই) মাধ্যমে তথ্য নেওয়ার বিষয়ে ইসিতে চিঠি দিয়েছিল। তবে ইসি এনটিএমসিকে আরেক চিঠিতে বলেছে, সংরক্ষিত জাতীয় তথ্য ভান্ডারের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে জন্মতারিখ ছাড়া শুধু এনআইডি নম্বর দিয়ে নিবন্ধিত নাগরিকের তথ্যাদি যাচাইয়ের বিষয়টি কমিশন অনুৎসাহিত করে।

ইসির দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির তথ্যভান্ডারে ১২ কোটি ১৮ লাখের বেশি নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষিত রয়েছে। গত বছরের জুন মাসে সেখান থেকে অনেক নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য বেহাতের ঘটনা প্রকাশ পায়। তখন তথ্য ফাঁস হয় মূলত জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন-সংক্রান্ত রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের (ওআরজিবিডিআর) ওয়েবসাইট থেকে। বিষয়টি শনাক্ত হওয়ার পর বেশ কিছুদিন এই প্রতিষ্ঠানকে এনআইডি যাচাই সেবা দেওয়া বন্ধ রেখেছিল ইসি। এ ছাড়া মাঝে ভূমি মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তরকে এই সেবা দেওয়া বন্ধ রেখেছিল কমিশন।

তথ্য বেহাতের ঘটনা প্রকাশের পর সরকারের ২৯টি ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’র প্রতিনিধিদের নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক। প্রতিষ্ঠানগুলোকে শর্ত মানার জন্য তাগাদা দেওয়া হয় ওই বৈঠকে।

সম্প্রতি মানুষের ব্যক্তিগত গোপন ও স্পর্শকাতর তথ্য কেনাবেচা করতে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গড়ে তোলা ১ হাজারের মতো অবৈধ ডিজিটাল হাটের সন্ধান পাওয়া যায়। এসব গোপন হাটে এনআইডি ও মোবাইল ফোনের কথোপকথনের (কল ডেটা রেকর্ড—সিডিআর) যাবতীয় রেকর্ড লেনদেন করা হচ্ছে। এমনকি ফোন ব্যবহারকারী কখন, কোথায় আসছেন-যাচ্ছেন, সে রকম ‘জীবন্ত’ তথ্যেরও হাতবদল হচ্ছে। এনটিএমসির তদন্তে এ কাজে দুটি সংস্থার সদস্যদের জড়িত থাকার প্রমাণও পাওয়া যায়। ওই দুই সংস্থায় একজন পুলিশ সুপারসহ চারজনকে শনাক্ত করা হয় তখন। তাঁদের মধ্যে একটি সংস্থার দুজনকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়।

 Ž  মার্চে এনটিএমসির মাধ্যমে সাড়ে চার লাখ নাগরিকের তথ্য যাচাই।

 Ž  এই সংখ্যাকে অস্বাভাবিক বলছে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ।

 Ž  সংস্থাগুলোর অতিরিক্ত তথ্য যাচাইয়ের চাপ পড়ছে বায়োমেট্রিক আইডেনটিফিকেশন সার্ভারে।