মাঠ ছাড়ছেন না সমন্বয়কেরা

কোটা সংস্কার আন্দোলন

গ্রেপ্তার হওয়া শেষ ব্যক্তিটি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউই মুক্ত নই। এই গণগ্রেপ্তার গণঘৃণার নামান্তর।হাসনাত আবদুল্লাহ, সমন্বয়ক যত দিন না এ বাংলাদেশ নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে; গণগ্রেপ্তার, জুলুম, নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে; তত দিন লড়াই চলবে।সারজিস আলম, সমন্বয়ক

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

অনেক নাটকীয়তার পর অবশেষে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজত থেকে মুক্তি পেয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক। নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলে ডিবি তাঁদের সপ্তাহখানেক আটকে রাখলেও তাঁরা বলছেন, তাঁদের সঙ্গে যা হয়েছে, সেটাকে নিরাপত্তা দেওয়া বলা চলে না। মুক্তির আগে তাঁরা ৩২ ঘণ্টা অনশনে ছিলেন বলেও জানিয়েছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে গণমাধ্যমে কথা না বলার শর্তে ডিবি পুলিশের গাড়িতে তাঁদের নিজ নিজ বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। অবশ্য বাসায় পৌঁছানোর পরই মুখ খুলতে শুরু করেন সমন্বয়কেরা।

মুক্তি পেয়েই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। তিনি লেখেন, ‘যত দিন না এ বাংলাদেশ আন্দোলনকারীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে; গণগ্রেপ্তার, জুলুম, নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে; তত দিন এ লড়াই চলবে।’

মুক্তি পাওয়া অপর সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, ‘এই আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়া শেষ ব্যক্তিটি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউই মুক্ত নই। এই গণগ্রেপ্তার গণঘৃণার নামান্তর।’

ছাড়া পাওয়া অপর চার সমন্বয়ক হলেন নাহিদ ইসলাম, আবু বাকের মজুমদার, আসিফ মাহমুদ ও নুসরাত তাবাসসুম।

গত ২৬ জুলাই শুক্রবার দুপুরে ঢাকার একটি হাসপাতাল থেকে কোটা আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার, আসিফ মাহমুদ ও নাহিদ ইসলামকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে আনা হয়। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে শনিবার সন্ধ্যায় আরও দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে হেফাজতে নেওয়া হয়। রোববার নেওয়া হয় নুসরাত তাবাসসুমকে।

প্রথম দিকে তাঁদের হেফাজতে

নেওয়ার কথা ডিবি স্বীকার না করলেও অনেক আলোচনা-সমালোচনার পর তা স্বীকার করে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ জানান, নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যই তাঁদের হেফাজতে নিয়ে রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে বলেন, ‘ছয় সমন্বয়ক নিজেদের নিরাপত্তার জন্য জিডি করেছিল। আজকে যখন তারা বলেছে যে তাদের আর নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই, তারা চলে যেতে চেয়েছে; আমরা তাদের বাধা দেইনি, তারা চলে গেছে।’

হেফাজত থেকে ছাড়া পাওয়া কয়েকজন সমন্বয়কারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডিবি হেফাজতে তাঁদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদা কক্ষে রাখা হয়। শুধু খাওয়ার সময় তাঁদের এক জায়গায় আনা হতো। কিন্তু কারও সঙ্গে কাউকে কথা বলতে দিত না। এমনকি এই আন্দোলন নিয়ে কী হচ্ছে, সে বিষয়েও জানতে দিত না।

জানতে চাইলে সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ আজকের পত্রিকাকে বলেন, কয়েক দিনে তাঁদের ভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছিল। শুধু কনফারেন্স ও খাওয়ার জন্য তাঁদের এক জায়গায় নেওয়া হলেও, গত ৩২ ঘণ্টা যাবৎ তাঁরা প্রত্যেকেই অনশন করেছেন।

নির্যাতন করা হয়েছিল কি না জানতে চাইলে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমার সাথে আচার-আচরণ বেশ ইতিবাচক হয়েছে—এটা আমি বলতে পারি না। এটাকে সিকিউরিটি বা নিরাপত্তা বলা চলে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন সার্বিকভাবে এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা সবাই এক সাথে কথা বলব।’

সারজিস আলমের ফেসবুক স্ট্যাটাস

মুক্তির পর সারজিস আলম তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, ‘কোথায় মহাখালীর সেতু ভবন আর কোথায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়! অথচ আপনারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে মহাখালীর সেতু ভবনে হামলার জন্য গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিলেন। সাথে আছে আসিফ মাহতাব স্যার, মাশরুরসহ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অসংখ্য শিক্ষার্থী। রিকশা থেকে নামিয়ে প্রিজন ভ্যানে তুলছেন, বাসা থেকে তুলে নিয়ে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছেন। আমার বোনদের রাস্তায় ফেলে পিটিয়েছেন। কী ভাবছেন? এভাবেই সবকিছু শেষ হয়ে যাবে?’

পুলিশ বাহিনীর উদ্দেশে সারজিস লেখেন, ‘এ দেশের মানুষের ক্ষোভ আপনাদের ওপর নয়, পুলিশের ওপর নয়। এই ক্ষোভ আপনার গায়ের ওই পোশাকটার ওপর। যে পোশাকটাকে ব্যবহার করে বছরের পর বছর আপনাদের দিয়ে এ দেশের অসংখ্য মানুষকে দমন-পীড়ন করা হয়েছে, অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে, জেল আর আদালতের প্রাঙ্গণে চক্কর কাটানো হয়েছে, সেই পোশাকটার ওপর। ওই পোশাকটা ছেড়ে আসুন আমাদের সাথে, বুকে টেনে নিব।’

আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, এই আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়া শেষ ব্যক্তিটি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউই মুক্ত নই। এই গণগ্রেপ্তার কেবল নিরপরাধ মানুষের অধিকার হরণ নয়, বরং আমাদের সমগ্র সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া একটি নিষ্ঠুরতার প্রতিফলন।

দুই সমন্বয়কের এই স্ট্যাটাসের খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনলাইন খবরে প্রকাশিত হয়। তবে এসব স্ট্যাটাস দেওয়ার ঘণ্টাখানেক পর সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহর ফেসবুক আইডি খুঁজে পাওয়া যায়নি।

 Ž  ডিবি হেফাজত থেকে মুক্তি পেলেন ছয় সমন্বয়ক।

 Ž  গণমাধ্যমে কথা বলতে মানা। পৌঁছে দেওয়া হয় বাসায়।

 Ž  মুক্তির আগে সমন্বয়কেরা ৩২ ঘণ্টা অনশন করেন।