Image View
Text View
Font Size
দুই-তৃতীয়াংশ ইনস্টিটিউটেরই জার্নাল নেই
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবাবিষয়ক বিশেষায়িত ইনস্টিটিউটগুলোর কাজের মধ্যে রয়েছে চিকিৎসকদের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়া, গবেষণা চালানো ও বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা দেওয়া। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, চিকিৎসকেরা বিভিন্ন ধরনের ও মাত্রার গবেষণাকাজ করেন। তবে এসব প্রচারের জন্য ৬৪ শতাংশ ইনস্টিটিউটেরই নিজস্ব জার্নাল প্রকাশিত হয় না। আবার কোনো কোনো ইনস্টিটিউটের জার্নাল থাকলেও প্রকাশনা অনিয়মিত। অথচ পদোন্নতির শর্ত পূরণ ছাড়াও চিকিৎসাসেবার মানোন্নয়নে জার্নালে প্রকাশের মাধ্যমে গবেষণা থেকে পাওয়া জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনেরা।
রাজধানীতে সরকারের ১৪টি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবাবিষয়ক বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ৯টিরই নিজস্ব বৈজ্ঞানিক জার্নাল নেই। বাকিগুলোর জার্নাল থাকলেও আন্তর্জাতিক পরিসরে তার কোনোটির স্থান হয়নি।
চিকিৎসাশিক্ষাবিষয়ক সরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর মেডিকেল এডুকেশনের (সিএমই) সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশে চিকিৎসকদের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সরকারের ১২টি মেডিকেল কলেজ, ৮টি ইনস্টিটিউট ও একটি সংস্থা রয়েছে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৭টি প্রতিষ্ঠান। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১১টি। এসব প্রতিষ্ঠান চিকিৎসকদের এমএস (মাস্টার্স অব সার্জারি), এমডি (ডক্টর অব মেডিসিন), এমএমইডি (মাস্টার্স ইন মেডিকেল এডুকেশন), এফসিপিএস (ফেলো অব কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস), এমসিপিএস (মেম্বারশিপ অব দ্য কলেজ অব বাংলাদেশ অ্যান্ড সার্জনস) ও এমফিল (মাস্টার্স অব ফিলোসফি) ডিগ্রি দিচ্ছে।
চিকিৎসাশিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে
দীর্ঘদিন কাজ করা কয়েকজন আজকের পত্রিকাকে বলেছেন, মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট ও সংস্থার অন্যতম মৌলিক কাজ গবেষণা করা। বিশেষায়িত ইনস্টিটিউটগুলোর কাজের অন্তর্ভুক্ত স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা দেওয়া এবং বিভিন্ন বিষয়ে উদ্ভাবনী গবেষণা করা। ইনস্টিটিউটগুলোর স্বল্প বা বড় পরিসরের কিছু গবেষণাকাজ থাকলেও নিজস্ব জার্নাল সবার নেই, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
দেশে ক্যানসারের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইসিআরএইচ)। ১৯৯৪ সালে ইনস্টিটিউটের মর্যাদা পাওয়া প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব জার্নাল নেই। এর কাছাকাছি থাকা জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইডিসিএইচ) ইনস্টিটিউট হিসেবে যাত্রা শুরু করে ১৯৭১ সালে। এ প্রতিষ্ঠানটিরও নিজস্ব কোনো জার্নাল নেই। বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. খায়রুল আনাম নিজস্ব জার্নালের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে বলেন, জনবলসংকটসহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে তা প্রকাশ করা যায়নি।
একইভাবে নিজস্ব গবেষণা জার্নাল নেই শীর্ষ চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট (এনআইসিভিডি) এবং জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর)। এ বিষয়ে এনআইসিভিডির পরিচালকের কার্যালয় জানিয়েছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) কাছে স্বীকৃতি চাওয়ার জন্য আগে জার্নালের তিন থেকে পাঁচটি সংখ্যা বের করতে হয়। ২০২৩ সালে এর কার্যক্রম শুরু করা হলেও পরে বিষয়টি আর এগোয়নি। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কার্ডিয়াক সোসাইটি ও হার্ট ফাউন্ডেশন যে জার্নাল বের করে, সেখানেই আমাদের চিকিৎসক ও শিক্ষকেরা অংশ নেন। জার্নাল করে মান ধরে রাখতে না পারলে লাভ নেই। তবে জার্নালের জন্য আমরা কাজ করব।’
রোগের প্রাদুর্ভাব, সংক্রামক রোগ এবং রোগতত্ত্ব নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এরও জার্নাল নেই। এ বিষয়ে পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, ‘ন্যাশনাল বুলেটিন অব পাবলিক হেলথ নামে আমরা বছরে দুটি বা তিনটি রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রকাশ করছি। তবে জনবলের সংকটের কারণে নিজস্ব জার্নাল বের করা কঠিন।’
একইভাবে নিজস্ব জার্নাল নেই জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউট, জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের।
আইন ও নীতিমালা অনুযায়ী জার্নালের অনুমোদন দেয় চিকিৎসাশিক্ষার পাঠ্যক্রম ও চিকিৎসকদের নিবন্ধন প্রদানকারী সংস্থা বিএমডিসি। সংস্থাটি বলছে, দেশে স্থানীয়ভাবে অনুমোদিত মেডিকেল জার্নালের সংখ্যা ১৭৮টি। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট, চিকিৎসকদের পেশাগত সংগঠন ও সংস্থা এগুলো প্রকাশ করে। বিএমডিসির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. লিয়াকত হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কোনো জার্নালের অনুমোদন ধরে রাখতে হলে বছরে দুইবার প্রকাশ করতে হবে। পরপর তিনটি সংখ্যা প্রকাশ না হলে জার্নালের স্বীকৃতি বাতিল হয়। মূলত পদোন্নতির জন্য এই জার্নালের নিবন্ধকে গুরুত্ব দেন চিকিৎসকেরা।’
এদিকে অনুমোদিত জার্নালগুলোও সব নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে না। যেমন জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটের (এনআইকেডিইউ) একসময় নিজস্ব জার্নাল থাকলেও সাত বছর ধরে তা প্রকাশ হচ্ছে না। পরপর তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত না হওয়ায় অনুমোদন বাতিল হয়েছে। এনআইকেডিইউর পরিচালক অধ্যাপক বাবরুল আলম বলেন, নিজস্ব জার্নাল প্রকাশের জন্য আবারও কাজ শুরু করেছেন তাঁরা। তাঁর মতে, ‘জার্নাল প্রকাশের জন্য যে গবেষণার সক্ষমতা, পরীক্ষাগার তথা আর্থিক সামর্থ্য প্রয়োজন, তা ইনস্টিটিউটগুলোর নেই। বিশেষায়িত জার্নাল কোনো সাধারণ প্রকাশনা নয়।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বরে ষষ্ঠ ভলিউমের দ্বিতীয় সংখ্যা বের করে। এখন চলতি বছরের জুন সংখ্যার কাজ চলছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটাল (এনআইএনএস) ২০১৫ সাল থেকে নিয়মিতভাবে জার্নাল প্রকাশ করছে। রোগ নির্ণয়বিষয়ক জাতীয় প্রতিষ্ঠান ও অভিনির্দেশক কেন্দ্র ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার ২০২০ সাল থেকে জার্নাল বের করছে। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট চলতি বছরের জুলাই সংখ্যা বের করার কাজ করছে বলে জানান পরিচালক অধ্যাপক খায়ের আহমেদ চৌধুরী। ‘দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি’ এ বিলম্বের কারণ বলে জানালেন তিনি।
‘জনবহুল এবং নানাবিধ জনস্বাস্থ্য সমস্যা থাকা বাংলাদেশ গবেষণার জন্য উপযুক্ত স্থান হলেও এদিকে আমরা পিছিয়ে’ বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ও ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসাশিক্ষা ও চিকিৎসাসেবাসহ এ-সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে গবেষণালব্ধ ফল হাতে থাকা প্রয়োজন। একাডেমিক জার্নাল না থাকলে মেডিকেলবিষয়ক প্রতিষ্ঠানের মৌলিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। যদিও বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে যেসব গবেষণা হয়, তা তেমন মানসম্মত নয়। বিশ্বের স্বীকৃত জার্নালে এসব গবেষণা স্থান পাওয়ার ঘটনা বিরল।’